• সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

সরকারি শতকোটি টাকার ভূমিতে আ’লীগ নেতার স্ত্রীর প্লানবিহীন বহুতল ভবন।

বরিশাল জেলা প্রতিনিধি।।
Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

বরিশাল জেলা প্রতিনিধি।

বহু অঘটন পটিয়াসি বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা এসএম জাকির হোসেনের স্ত্রীর নামেও রয়েছে শতকোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করাসহ সাবেক জেলা প্রশাসক ও গুটিকয়েক কর্মচারীকে ঘুস দিয়ে বরিশাল বেলসপার্কসংলগ্ন মহামূল্যবান ভূমিটি কব্জা করেছেন। এমনকি ভূমি আইন লঙ্ঘন করে সেখানে বহুতল বভন নির্মাণ শেষে ইউরো ক্যাফে নামক কথিত এই রেস্তোরাঁ থেকে কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতেও রেস্তোরাঁটিতে একাধিকবার বৈঠক করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে কথিত রেস্তোরাঁ অর্থাৎ নৌকার প্রচার কেন্দ্রটিতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছেন হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা।জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. অজিয়র রহমানসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বেলসপার্কসংলগ্ন অফিসার্স ক্লাবের মূল্যবান ভূমিটি বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা এসএম জাকির হোসেন তার স্ত্রী ফাতেমা ফারুকীর নামে বরাদ্দ নিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বহুতল ভবন বা রেস্তোরাঁ করা হলে পার্শ্ববর্তী সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের কজন কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাত ভাই সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে দিয়ে চাপপ্রয়োগ করেন। ফলে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা জাকিরের স্ত্রীর নামে সরকারি ভূমিটি ১০ বছরের জন্য ইজারা দিতে বাধ্য হন তৎকালীন জেলা প্রশাসক।জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারি ইজারাপ্রাপ্ত ভূমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের সুযোগ আইনে নেই। কিন্তু তারপরেও ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করাসহ তৎকালীন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তিনি তিনতলা ভবন করেছেন। এবং ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও জাকির হোসেন মডেল স্কুল এন্ড কলেজ লাগোয়া ভবনটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ওই ভবন থেকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির পক্ষে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা, এমনকি নির্বাচনী কার্যক্রমও চালানো হয়।আওয়ামী লীগের শাসনামলের সময় সারা দেশে অবৈধভাবে নির্মিত ভবনগুলোর অধিকাংশ ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভেঙে ফেললেও বরিশালের আ’লীগ নেতা জাকিরের ভবনটি এখনও সুরক্ষিত আছে এবং সেখানে তিনি এখনও ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন।জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা এসএম জাকির সরকারি ভূমিতে অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে ইমারত নির্মাণ আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। কোনো প্রকার নির্মাণশৈলী ছাড়াই তিনি বেলসপার্কসংলগ্ন ভূমিতে ভবনটি করেছেন। এবং ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে অবৈধ ভবনের প্লান করতে সিটি কর্পোরেশনের দৌঁড়ঝাপও শুরু হয়।এই তথ্য নিশ্চিত করে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সূত্র জানিয়েছে, কোনো অমুমোদন না নিয়েই ইউরো ক্যাফে নামক রেস্তোরাঁটি নির্মাণ করা হয়েছে, যা পুরোপুরি অবৈধ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে ভবনটির নির্মাণশৈলী নিতে কয়েকবার লোকজন এসেছিল। কিন্তু কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা এসএম জাকির হোসেনের স্ত্রীর নামে শুধু ইউরো ক্যাফের ভূমিই ইজারা দেওয়া হয়নি, অফিসার্স মেসের দুটি কক্ষও বরাদ্দ দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। সেখানে জাকিরের ইউরো কনভেনশন হল নামের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও করেছেন। জেলা প্রশাসনকে নামমাত্র রাজস্ব দিয়ে উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক বছর ধরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচার-প্রচারণা।সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বরিশাল সদর উপজেলা থেকে এসএম জাকির হোসেন চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচন পরিচালনা করা হয় সরকারি ভূমিতে থাকা ওই দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এমনকি চলতি বছরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের এক তরফা সাংসদ নির্বাচনেও দুটি ভবনকে প্রচারকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতেও ভবনটিতে কয়েক দফা বৈঠক করেন এসএম জাকিরসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।ক্ষমতার আমলে শুধু বরিশালে নয়, এসএম জাকির সন্ত্রাসের ডালপালা রাজধানী ঢাকায়ও বিস্তৃত করেছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পূর্বাপর তিনি রাজধানীতেও ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে মূর্তিমান সন্ত্রাস রুপে আবির্ভুত হয়েছিলেন। তার নেত্রীকে দেশ ছাড়া করার ক্ষোভে জাকির ওই দিন রাতে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে হামলা চালিয়েছেন। এবং এতে আল-আমিন নামের এক আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন, যে ঘটনায় নিহত আল-আমিনের চাচা বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বরিশালের আওয়ামী সন্ত্রাসী জাকিরসহ ৫ শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। জানা গেছে, বাড্ডার ওই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জাকিরের সাথে তার বরিশালের আরও অন্তত ১০/১২ সহযোগী অংশ নিয়েছিল। অবশ্য তাদের কারও নাম মামলাটিতে না থাকলেও পুলিশ জানিয়েছে, তদন্তে সকলের নাম উঠে আসবে এবং তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী সন্ত্রাসী জাকির জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রাক্কালে বরিশাল এবং ঢাকা উভয়স্থনে অবস্থান করছিলেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় তিনি অবস্থান নিয়ে থাকলেও একেক সময় একেক জায়গায় গুন্ডাবাহিনী নিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে। ৫ আগস্ট সকার পতনের পরে তিনি কদিন আত্মরক্ষার্থে অন্তর্ধানে থাকলেও পরবর্তীতে কৌশলে বরিশালে এসে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার মরিয়া চেষ্টা করেন। কিন্তু অতীত অপকর্মের কারণে তিনি তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি, এর মধ্যেই প্রকাশ্যে আসল বাড্ডায় তার নেতৃত্বে ৫ আগস্ট আন্দোলনকারী খুনের তথ্য-উপাত্ত্ব, যা বরিশালের রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সুশীলমহলকে রীতিমত হতবাক-বাকরুদ্ধ করেছে।আন্দোলনকারীকে খুন করাসহ আওয়ামী লীগ নেতা এসএম জাকিরের অতীত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ করেছে বরিশালের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাদের ভাষায়, এসএম জাকির সক্ষমতার আমলে দখল সন্ত্রাস, সাংবাদিক নিপিড়নসহ সরকারি শতকোটি টাকার ভূমি পর্যন্ত দখল করেছেন। তার হাত থেকে রেহাই পাননি নারী সাংবাদিকও।লেবাসধারী এই আওয়ামী লীগ নেতা শাসনামলে কোটি কোটি টাকা কামানোর পাশাপাশি খিস্ট্রান সম্প্রদায়কে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাকে ওই সম্প্রদায়টি সন্ত্রাস ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেও উল্লেখ করে তৎসময়ে শাস্তি দাবি করেছিল। কিন্তু জাকির একতো আ’লীগের পদধারী নেতা, তদুপরি স্থানীয় মন্ত্রী, মেয়র, এমনকি সাবেক আইসিটি মন্ত্রী জুনায়েদ আহম্মেদ পলকের আস্থাভাজন হওয়ায় তার লাগাগ টানা সম্ভবপর হয়নি। ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে থানা পুলিশ কিংবা আদালতে গিয়ে ন্যায় বিচার পাননি, বরং আরও হয়রানির শিকার হতে হয়।বিশেষ করে সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ লাগোয়া সরকারি শতকোটি টাকার ভূমিতে তার নকশাবর্হিভুত বহুতল ভবন নির্মাণ এবং সেখানে কথিত রেস্তোরাঁ থেকে আ’লীগের প্রচার-প্রচারণার বিরোধীতা করতে গিয়েও অনেকে হয়রানির শিকার হন।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতা এসএম জাকির স্কুলের পাশে সরকারি জমিতে এমন ভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন, সেখান থেকে স্কুলের নারী শিক্ষার্থীদের মুভমেন্টের ছবি বা ভিডিও ধারন করা খুব সহজ। এতে শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীরাও চাইছেন স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোষর জাকিরের স্ত্রী নামের নির্মিত ভবনটি দ্রুত অপসারণ বা ভেঙে ফেলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।এতসব বিতর্কের মধেই সরকারি ভূমিতে নির্মিত অবৈধ ভবনটির প্লান নিতে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন জাকির এবং তার সন্ত্রাসী বাহিনী। সিটি কর্পোরেশন সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে, অবৈধ ভবনটির প্লান নিতে ৫ আগস্টের পরে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি ভূমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে পরে প্লান নেওয়ার সুযোগ নেই।বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্লান শাখার একজন কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, সরকারি ভূমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগ নেতা জাকিরের স্ত্রীর নামের ভবনটির কোনো আইন মেনে করা হয়নি। তাছাড়া ক্ষমতার দাপটে তিনি ভূমি আইনও লঙ্ঘন করেছেন, যা তদন্তে উঠে এসেছে। সবকিছু বিবেচনা করে ভবনটির প্লান না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।এদিকে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, রাজধানী আন্দোলনকারী খুনে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া জাকিরের স্ত্রীর নামে নকশা বর্হিভুত ভবনটি উচ্ছেদে বরিশাল আদালতে একটি মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে সমাজকর্মীরা। সম্ভবত এই মামলাটি আগামী সপ্তাহের মধ্যে হওয়ার একটি জোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীর এসব কর্মকান্ড প্রকাশ্যে আসতেই তিনি গাঢাকা দিয়েছেন। এবং তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদেরও বৃহস্পতিবার থেকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।ধারনা করা হচ্ছে, রাজধানীর বাড্ডায় আন্দোলনকারী খুনের তথ্য এবং মামলার খবর প্রকাশ্যে আসতেই এসএম জাকির গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে গিয়েছেন। এবং খুনের মামলা থেকে রেহাই পেতে বাদীকে ম্যানেজ করতে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় বা নিরাপদ কোথাও অবস্থান নিয়ে আছেনমোহাম্মদপুর বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালীন জাকিরকে একাধিকবার সেখানে যাতায়াত করেতে দেখা যায়। কিন্তু তিনি যে বরিশালে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে রাজধানীতে কিলিং মিশনে অংশ নেবেন, এমনটা কারও ধারনাও ছিল না। এই খুনিকে দেখা মাত্রাই গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দিতে মোহাম্মপুরের বাসিন্দারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।এদিকে সরকারি ভূমিতে অবৈধ ভবন নির্মাণ এবং সেখান থেকে বছরের পর বছর স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের প্রচার চালানো নিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে। তারা ভবনটি জাকিরের কব্জা থেকে উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন।তবে এই বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলতে আপত্তি জানিয়েছেন বরিশালের নতুন জেলা প্রশাসক ও অফিসার্স ক্লাবের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ভূমিটি পূর্বের জেলা প্রশাসক বরাদ্দ দিয়ে গেছেন, ফলে না জেনে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছেন

না।

 

 


এ বিভাগের আরও সংবাদ